গর্ভধারণ একজন মহিলার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর একটি পর্যায় এবং এসময় ক্রমাগত স্বাস্থ্য পরীক্ষা প্রয়োজন। কিন্তু এই সময় সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার মানে শুধু ওজন মাপা এবং ভিটামিন খাওয়া নয়, এই সময় রক্তচাপ ও কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখাও অত্যন্ত জরুরি।
একাধিক জন্মদান ও বেশী বয়সে গর্ভধারণের বর্ধিত হার, এই দুটি সমস্যাকে একসঙ্গে নিয়ন্ত্রনে রাখা ইদানিং মুশকিল করে তুলেছে যে কারণে গর্ভবতী অবস্থায় এক জাতীয় উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়া অনেক বেড়ে গেছে।
গর্ভবতী মহিলাদের মধ্যে প্রায় ৭ থেকে ১০ শতাংশ গর্ভাবস্থা জনিত উচ্চ রক্তচাপ (পিআইএইচ) এর শিকার হয়।
সমস্যাটির বিষয়ে আরও ভালভাবে বোঝার জন্য আমরা ব্লুম আইভিএফ গ্রুপের মেডিকেল ডিরেক্টর এবং অবস্টেক্ট্রিকস অ্যান্ড গানেকোলজিক্যাল সোসাইটিস ফেডারেশনের অফ ইন্ডিয়া, মুম্বাইয়ের মহাসচিব ডাঃ ঋষিকেশ ডি পাই মহাশয়ের সঙ্গে কথা বলি।
গর্ভাবস্থা-জনিত উচ্চ রক্তচাপ কি?
ডাঃ পাই ব্যাখ্যা করেন, "এই অবস্থায় কোনও কোনও গর্ভবতী মহিলার রক্তচাপ বেড়ে যায়। এই অবস্থা বেশিরভাগ বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই সাময়িক যদিও ব্যতিক্রম হিসেবে কয়েকটি ক্ষেত্রে এটি প্রসবের পরেও চলতে থাকে। গর্ভাবস্থা-জনিত উচ্চ রক্তচাপ (PIH), প্রিল্ক্যাম্পসিয়া নামেও পরিচিত এবং এটি প্রথম গর্ভবতী তরুনীদের মধ্যে বেশী দেখা যায়। যদি চিকিৎসা না করা হয়, তাহলে এর জন্য শিশু ও মা উভয়েরই গুরুতর উপসর্গ দেখা দিতে পারে।"
তিনি পরামর্শ দেন যে এর লক্ষণগুলির প্রতি নজর রাখতে যাতে অবিলম্বে চিকিৎসা শুরু করা যায়।
গর্ভাবস্থা-জনিত উচ্চ রক্তচাপের ১৩ টি লক্ষণ
গর্ভাবস্থা-জনিত উচ্চ রক্তচাপকে নিম্নলিখিত প্রধান লক্ষণগুলি দ্বারা সনাক্ত করা যেতে পারে।
- দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ত্রৈমাসিকে রক্তচাপে বৃদ্ধি।
- প্রস্রাবের নমুনাতে প্রোটিনের উপস্থিতি।
- দেহ ফুলে যাওয়া।
- অস্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধি যা গর্ভাবস্থার সাথে সম্পর্কিত নয়।
- চোখে ঝাপসা দেখা বা দুটি করে দেখা।
- বমি করা এবং বমি বমি ভাব।
- পেটে ব্যথা এবং অস্বস্তি।
- ঘন ঘন প্রস্রাব পাওয়া বা খুব কম পরিমাণে মূত্রত্যাগ করা।
- লিভার এবং কিডনি কার্যকারিতা পরীক্ষার অস্বাভাবিক ফলাফল।
- রক্ত জমাট বাঁধায় অসুবিধা।
- প্রস্রাবে রক্তের উপস্থিতি।
- হৃৎস্পন্দনের গতি বৃদ্ধি।
- জ্বর আসা এবং কানে ঝিঁ ঝিঁ শব্দ হওয়া।
"মহিলাদের নির্দিষ্ট কিছু শারীরিক এবং স্বাস্থ্যগত অবস্থায় প্রিক্ল্যাম্পাসিয়া হবার ঝুঁকি বেশী থাকে। উদাহরণস্বরূপ, যেসব মহিলাদের উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি রোগ, ডায়াবেটিস, এবং প্রথম বারের গর্ভাবস্থায় প্রিক্ল্যাম্পাসিয়ার ইতিহাস আছে অথবা একাধিক ভ্রণের সাথে গর্ভবতী মহিলাদের এই জটিলতা হতে পারে।" ডাঃ পাই সবিস্তারে বোঝান।
অন্যান্য অসুখের মতো গর্ভ-জনিত উচ্চ রক্তচাপও জটিলতা মুক্ত নয়।

গর্ভাবস্থা-জনিত উচ্চ রক্তচাপের কারণে জটিলতা
ডাঃ পাই আরও ব্যাখ্যা করেন, "উচ্চ রক্তচাপের কারণে এই রোগীদের রক্ত নালিকায় এক প্রতিরোধের সৃষ্টি হয়। এর ফলে গর্ভস্থ ভ্রুণ এবং গর্ভাশয় সহ পুরো শরীরের রক্ত প্রবাহ বাধা প্রাপ্ত হওয়ায় ভ্রূণের বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত হয়।"
তিনি আরও যোগ করেন যে এই ধরণের রক্তচাপের কারণে সময়ের আগেই গর্ভের ফুল জরায়ু থেকে বিচ্যুত হতে পারে, গর্ভাশয়ে অক্সিজেনের প্রবাহ ব্যাহত হওয়ার দরুন ভ্রূণের বৃদ্ধি বিলম্বিত হতে পারে, এমনকি চরম অবস্থায় মৃত সন্তান প্রসব হতে পারে।
"এই অবস্থায় মারাত্মক পরিণতি, যেমন সময়ের আগে জন্মানো, সিজার, মা-শিশুর মৃত্যু, ইত্যাদি এড়াতে রোগটি অবিলম্বে সনাক্ত করে যথোচিত চিকিৎসা শুরু করা উচিৎ।" ডাঃ পাই এর পরামর্শ।
গর্ভাবস্থা-জনিত উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা
ডাঃ পাই বলেন যে এই রোগে ভুগছে এমন মহিলাকে পূর্ণ বিশ্রাম নিতে বলা হয় বা কয়েকটি ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি করে ক্রমাগত ভ্রূণ পর্যবেক্ষণ করা হয়।
"তাকে রক্তচাপের ওঠানামা নথিবদ্ধ করার জন্য ঘন ঘন রক্তচাপের পরীক্ষা করাতে এবং প্রস্রাবের নমুনা দেখাতে বলা যেতে পারে। গর্ভের ফুসফুসের উন্নয়নকে সক্রিয় করার জন্য অনেককে কর্টিকোস্টেরয়েড দেওয়া হয়। নিয়মিত ডোপ্লার ফ্লো স্টাডিজ এবং শরীরবৃত্তীয় বিবরণী ডাক্তারকে ভ্রূণের বৃদ্ধির উপর নজর রাখতে সাহায্য করে। কিছু ক্ষেত্রে যাবতীয় চিকিৎসা এবং ওষুধপত্র সময়ের আগে প্রসবের বার্তা দিতে পারে," তিনি যোগ করেন।
গর্ভাবস্থা-জনিত উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসার বিধান চূড়ান্ত করার জন্য, তাঁরা সম্পূর্ণভাবে নারীর সামগ্রিক স্বাস্থ্য, গর্ভাবস্থার পর্যায় এবং পূর্বের চিকিৎসা ইতিহাসের ওপর নির্ভর করেন।
নতুন মা'দের যে কথাগুলি মনে রাখা উচিত
ডাঃ পাই বলেন যে "মনে রাখবেন যে ডাক্তারেরা রক্তচাপের ব্যাপকতা এবং রোগীর সহনশীলতার মাত্রা মাথায় রেখে নির্দিষ্ট ঔষধ বা থেরাপি বিবেচনা করেন"।
গর্ভাবস্থা জনিত উচ্চ রক্তচাপ ৪০ বছরের বেশী বয়সী গর্ভবতী মহিলাদের মধ্যে বা গর্ভবতী কিশোরীদের মধ্যেই সচরাচর দেখা যায়। সেজন্য জটিলতাগুলি এড়াতে নিখুঁতভাবে প্রসবকালীন চেক-আপগুলি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ডাঃ পাই এর আরও পরামর্শ, "এই রোগে আক্রান্ত মহিলাদের নিরাপদ প্রসবের জন্য নিয়মিত নজরে রাখা, ভ্রূণের স্বাভাবিক বৃদ্ধি হচ্ছে কি না এবং সাধারণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা অত্যন্ত জরুরী। এটা মাথায় রাখা জরুরী যে রক্তচাপের যাবতীয় ওঠানামা মহিলার গর্ভাবস্থা জনিত উচ্চ রক্তচাপের জন্য না হতেও পারে। কোনও মহিলার গর্ভাবস্থা জনিত উচ্চ রক্তচাপ আছে কিনা তা নিশ্চিত করার সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে রোগীকে পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করা এবং নিয়মিত তার রক্ত পরীক্ষা করানো।"
Source: theindusparent