সেলিব্রিটি পুষ্টিবিজ্ঞানী, ঋজুতা দিবেকার সম্প্রতি নারীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী হরমোনের ভারসাম্যহীনতা নিয়ে তাঁর পিসিওডি-থাইরয়েড বইএ একটি বিতর্কের সূচনা করেছিলেন।
এই মাসের প্রথম দিকে (মার্চ) বেঙ্গালুরুতে বইয়ের উদ্বোধনের সময় একটি অগ্রণী সংবাদপত্রের সঙ্গে কথা বলার সময় দিবেকার বলেছিলেন, “থাইরয়েড এবং পলিসিস্টিক ডিম্বাশয় ডিসর্ডার (পিসিওডি) শহুরে মহামারীর মতো বেড়ে চলেছে। আমি পৃথিবীর নানা জায়গার বহু নারীর কাছ থেকে ই-মেল ও সোশ্যাল মিডিয়া মেসেজ পেয়েছি যাঁরা এর কবল থেকে বাঁচার জন্য সংঘর্ষ করছেন।”
ভারতে পিসিওডি
হরমোনের এই অসাম্য ভারতে অনেক নারীকে কাবু করে। সম্প্রতি মেট্রোপলিটিক্স হেলথকেয়ার লিমিটেড কর্তৃক সারা ভারতে এক সমীক্ষা চালানো হয় যাতে ১৮ মাস ধরে টেসটোসটেরোনের ২৭,৪১১ নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এই ২৭,৪১১ নমুনার মধ্যে, প্রায় ৪,৮২৪ টি (১৭.৬০%) নারী পলিসিস্টিক ডিম্বাশয় সিন্ড্রোম সহ হরমোনের ঝুঁকি সম্মুখীন।
পলিসিস্টিক ওভারি রোগ (পিসিওডি) কী?
পলিসিস্টিক ওভারি রোগ (পিসিওডি), এমন একটি ব্যাধি যেখানে একটি মহিলার ডিম্বাশয় বড় হয় এবং সেখানে ০.৫-১.০ সেন্টিমিটার ব্যাসের ছোট ছোট ফলিকুলার সিস্ট বিকশিত হয়। এর ফলে ডিম্বাশয়ে ডিম্বানু জমা হয় যা শরীর থেকে বেরোতে পারে না।

সাউথএন্ড আইভিএফ প্রজনন কেন্দ্র, দিল্লির ডাঃ সোনিয়া মালিক আরও ব্যাখ্যা করেন, “পিসিওডি আক্রান্ত একটি মহিলার এমন উপসর্গও থাকবে যা প্রজনন ও অন্যান্য হরমোন ঘটিত ভারসাম্যহীণতাকে প্রতিফলিত করবে। এখানে, ডিম্বাশয় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি এন্ড্রোজেন (পুরুষ হরমোন) নিঃসৃত করে। এই হরমোনের আধিক্য ডিম্বস্ফোটনের সময় ডিম্বানুর নিঃসরণ এবং বিকাসকে প্রভাবিত করে।”
তিনি পিসিওডি-র নিম্নলিখিত উপসর্গগুলি, তালিকাভুক্ত করেন,যা সব বয়সের মহিলাদের হতে পারে এবং পরিবর্তনশীলও হতে পারে :
- বয়ঃসন্ধিকালীন মেয়েদের মধ্যে উপসর্গগুলি হল বিরল, অনুপস্থিত, এবং / অথবা অনিয়মিত মাসিক ঋতুস্রাব আর চুল পড়া।
- প্রজননের বয়সকালে, উর্বরতা ঘটিত সমস্যাগুলির মুখোমুখি হতে হয় বলে নারীদের সন্তানধারণ করতে চিকিৎসার সাহায্য দরকার হয়। বস্তুতঃ, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মহিলা বন্ধ্যাত্বের কারণ পিসিওএস।
- চুল গজানো – মুখে, বুকে, পেটে, পিছনে, অঙ্গুষ্ঠে, বা পায়ের আঙ্গুলে চুল গজানো ও বাড়া।
- ডিম্ব্রবাশয়ে সিস্ট হলে সেই সঙ্গে ব্রণ, তৈলাক্ত ত্বক বা খুশকি হতে পারে।
- এতে ওজন বাড়া বা স্থূলতা হতে পারে, সাধারণতঃ কোমরের চারপাশে ওজন বাড়ে এবং পুরুষের মতো টেকো ভাব বা চুল পাতলা হয়ে যায়।
- ঘাড়, হাত, স্তন বা উরুতে চামড়ায় পুরু গাঢ় বাদামী বা কালো প্যাচ দেখা যেতে পারে – বাহুসন্ধিতে বা ঘাড়ের ত্বকে অতিরিক্ত ছালের ছিলকা।
ডাঃ মালিক বলেন যে অনেক রকম কারণে পিসিওডির প্রাদুর্ভাব বছরে বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি আরও বলেছেন, “জীবনচর্যায় পরিবর্তন, ব্যায়ামের অভাব, খাদ্যাভ্যাস, পরিবেশগত দূষণ, চাপের মাত্রা এবং কর্মক্ষেত্র ও জীবনের ভারসাম্য হারানো পিসিওডির প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে যা আবার উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস মেলিটাস, জরায়ুর ক্যান্সারের ঝুঁকিসম্পন্ন এবং এমনকি হৃদরোগও হতে পারে।”
PCOD এর প্রতিকার সম্পর্কে আরো জানতে হলে পড়ে চলুন।
পিসিওডি র প্রতিকার
বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে যদি লক্ষণগুলি প্রথমেই সনাক্ত করে নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাহলে ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের মত জটিল ব্যাধির সম্ভাবনা কমাতে সাহায্য করে। “তবে, কেউ স্বাস্থ্যের সমস্যা যাতে না হয়, তার জন্য কিছু পদক্ষেপ নিতেই পারে,” ডাঃ মালিক বলেন ও ব্যাখ্যা করেন যে প্রাথমিক পদক্ষেপগুলি হচ্ছে, সঠিকভাবে খাচ্ছেন, ব্যায়াম করছেন এবং ধূমপান করছেন না।
# ১। লাইফস্টাইল পরিবর্তন
“পিসিওডি আক্রান্ত মহিলারা বাড়তি ওজনের কারণে স্থূলকায়া হন, যে কারণে নানা স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। স্বাস্থ্যকর খাবার ও ব্যায়াম দ্বারা ওজনকে সীমার মধ্যে রেখে পিসিওডি নিয়ন্ত্রণ করা যায়,” বললেন ডাঃ মালিক। আপনি এগুলি করতে পারেন –
- প্রক্রিয়াকৃত ও বাড়তি চিনিযুক্ত খাদ্য কমিয়ে আনুন।
- খাদ্য শস্য, ফল, শব্জী এবং হালকা মাংস বেশী করে খান। তিনি আরও বলেন, “এর ফলে রক্তে শর্করার পরিমান কমবে, শরীরে ইন্সুলিনের ব্যাবহার যথাযথ হবে এবং হরমোনের নিঃসরণ স্বাভাবিক হবে। শরীরের ওজন শতকরা দশ ভাগ কমলেই আপনার ঋতুচক্র স্বাভাবিক এবং নিয়মিত হবে”।
# ২। খাদ্যতালিকায় পরিবর্তন
You must include whole grains in your daily diet to make up for the needed amount of protein
- বেশী চিনি যুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন। মনে রাখবেন যে সবচেয়ে খারাপ হচ্ছে নরম পানীয়, কুকিজ, কেক, চকলেট, মিষ্টি, এবং প্রক্রিয়াকৃত ব্রেকফাস্ট সিরিয়াল।
- উচ্চ-ফ্রুক্টোজ ভুট্টা সিরাপের মতো অস্বাস্থ্যকর শর্করা যৌগ যুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন।
- শব্জি খাওয়া বাড়ান এবং প্রতিদিন কম করে পাঁচ রকম শব্জি্র পদ রাখুন।
- বীজযুক্ত ব্রেকফাস্ট সিরিয়াল, সাদা রুটি, এবং পাস্তা বর্জন করুন এবং কম পরিমাণে পুরোপুরি শস্য ভিত্তিক বিকল্প খাদ্য চয়ন করুন।
- ফাইবার রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণের এবং সুস্থ আন্ত্রিক ক্রিয়ার সহায়ক। প্রতিদিন ২৫-৩০ গ্রাম ফাইবার (আঁশ যুক্ত খাবার) খেতে হবে।
- প্রোটিন আপনার রক্তে শর্করার সামঞ্জস্য রাখতে সহায়তা করে এবং মিষ্টান্ন প্রীতি বশে আনতে সাহায্য করে। আপনার খাদ্যতে তাজা মাছ, পাতলা লাল মাংস, জৈব মুরগি, জৈবিক ডিম, গোটা শস্য এবং লেজুস অন্তর্ভুক্ত করুন, যা প্রোটিনের ভাল উৎস।
- খাবারে কোন ধরণের চর্বি খাচ্ছেন, তা কোষ পর্যায়ে ইনসুলিন পেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঠান্ডা জলের মাছ, জৈবিক ডিম, আভোকাডো, বিশুদ্ধ অলিভ তেল, এবং অপরিহার্য ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ কাঁচা বাদাম ও বীজ খেতে পারেন।
- নিয়মিত খেতে এবং খাবারের মধ্যে আপনার রক্তের শর্করার মাত্রা বজায় রাখার জন্য সকালে এবং বিকেলে স্বাস্থ্যকর খাবার নিশ্চিত করুন।
- এছাড়াও আপনি ফল, বাদাম, বীজ এবং প্রাকৃতিক দই সহ সব সুস্থ খাবার খান।
# ৩। জন্মনিয়ন্ত্রণের পিল
আপনি আপনার গাইনোকোলোজিস্টকেও জিজ্ঞাসা করতে পারেন যে আপনি জন্মনিয়ন্ত্রণের ট্যাবলেট খেতে পারেন কি না এবং যদি পারেন, তবে কোনটি উপযুক্ত? যে মহিলারা গর্ভবতী হতে চান না, তাদের জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ পিলগুলি অত্যন্ত সহায়ক। তারা নিম্নলিখিত কাজ করে:
- ঋতুচক্র নিয়ন্ত্রণ করে
- পুরুষ হরমোনের মাত্রা কমায়
- ব্রণ পরিষ্কারে সাহায্য করে
# ৪। ডায়াবেটিসের ঔষধ
“টাইপ ২ ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় মেটফরমিন (গ্লুকোফাজ) ব্যবহৃত হয়। ইনসুলিন যেভাবে রক্তের গ্লুকোজ (চিনি) নিয়ন্ত্রণ করে এবং টেসটোসটেরোন উৎপাদন কমিয়ে আনে মেটারফরমিন তাকে প্রভাবিত করে। এটি অস্বাভাবিক চুলের বৃদ্ধিকে কম করে এবং কয়েক মাস ব্যবহার করলে, ডিম্বানুস্ফোটন ফিরে আসতে পারে,” – ডাঃ মালিকের পরামর্শ।
তিনি আরও বলেন যে সাম্প্রতিক গবেষণায় মেটফরমিনের অন্যান্য ইতিবাচক প্রভাব দেখা গেছে, যেমন ওজন কমা এবং উন্নত কোলেস্টেরল মাত্রা। তিনি বলেন, “মেটফরমি্নে কেউ ডায়াবেটিক হতে পারে না।”
# ৫। অস্ত্রোপচার
ওভারিয়ান ড্রিলিং একটি সার্জারি যার দ্বারা ডিম্বাণু স্ফোটনের সম্ভাবনা বাড়ে। মহিলার উর্বরতা বাড়ার ওষুধে কাজ না হলে কখনও কখনও এটি করা হয়।
# ৬। চুল বৃদ্ধি বা অতিরিক্ত পুরুষ হরমোন জনিত ওষুধ
“অ্যান্টি-অ্যান্ড্রোজেন জাতীয় ওষুধ চুল বাড়া কমায় আর ব্রণ সাফ করে। স্পাইরোল্যাক্টোন (অ্যাল্ডাক্টোন), যা প্রথমে উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসায় ব্যাবহৃত হত, তা পিসিওডি কমাতেও কাজে লাগছে। অবশ্য যদি আপনি গর্ভধারণ করতে চাইছেন তাহলে এই ওষুধ না খাওয়াই ভাল”, ডাঃ মালিক বললেন। তিনি অন্য কয়েকটি বিকল্প সূচীবদ্ধ করেছেন :-
- মুখের রোম দূর করতে ভ্যানিকা ক্রীম
- লেসার দ্বারা চুল হটানো কিংবা ইলেল্ট্রোলিসিস দ্বারা
- হরমোনের চিকিৎসা করে নোতুন চুল গজানো বন্ধ করা
তিনি আরও বলেন যে কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে বেরিয়াট্রিক (ওজন কমানো) সার্জারি দ্বারা অস্বাস্থ্যকর রকমের মোটা মহিলাদের (দেহ-ভর সূচক ৪০ এর বেশী) পিসিওডি সারানো যেতে পারে।
# ৭। প্রজনন সমস্যার ঔষধ
“ডিম্বানুর অভাব সাধারণত পিসিওডি আক্রান্ত মহিলাদের প্রজনন সংক্রান্ত সমস্যার কারণ। যেসব ওষুধ ডিম্বানু স্ফোটন ত্বরাণ্বিত করে সেগুলি পিসিওডি আক্রান্ত মহিলাদের গর্ভবতী হতেও সাহায্য করে। তবুও, উর্বরতা বৃদ্ধির ঔষধগুলি শুরু করার আগে নারী ও পুরুষ, উভয়ের ক্ষেত্রে বন্ধ্যাত্বের কিছু অন্যান্য কারণ আছে কি না সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া উচিত। আবার, কিছু উর্বরতার ওষুধ একাধিক জন্মের ঝুঁকি সম্পন্ন (যমজ, তিনটি),” ডাঃ মালিক বলেন।
তিনি নিম্নলিখিত বিকল্প চিকিৎসা তালিকাভুক্ত করেছেন :
- ক্লোমিফেন (ক্লোমিড, স্যারোফিন) : অধিকাংশ রোগীর ডিম্বানু নিঃসরণ উদ্দীপিত করার জন্য প্রথম পছন্দ।
- ক্লোমিফেন এর সঙ্গে মেটফরমিন গ্রহণ : একা ক্লোমিফেনে কাজ না হলে এভাবে একসঙ্গে দেওয়া যেতে পারে। কম মাত্রায় এই দুই ওষুধে পিসিওডি আক্রান্ত মহিলাদের ডিম্বানু নিঃসরণ হতে পারে।
- গোনাডোট্রপিন্স : এটি দামী ওষুধ এবং বিশেষ প্রচেষ্টা হিসাবে দেওয়া হয়, কিন্তু ক্লোমিফেন এর তুলনায় এতে একাধিক শিশু জন্মানোর সম্ভাবনা বেশী।
আরেকটি বিকল্প হল, ‘ইন ভিট্রো ফারটিলাইজেশন’ (আইভিএফ), যা কোনও ঋতুচক্রে গর্ভবতী হওয়ার সুযোগ দেয়। এটি ডাক্তারকে যমজ সন্তানের জন্ম নিয়ন্ত্রণ করতে আরো ভাল সাহায্য করে।
বেশীরভাগ মহিলাদের লক্ষণগুলি সাধারণত মেনোপজের সাথে সম্পর্কিত। “এগুলি হল, গা গরম, শুষ্ক যোনি, মেজাজ হারানো, রাতে ঘাম, অথবা অনিদ্রা। ঋতুচক্র অনিয়মিত হতে পারে বা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কিছু নারীর মাসিক আর কখনই শুরু হয় না এবং যৌবনারম্ভের সাধারণ অনুক্রম আর ফিরে আসে না,” ডাঃ মালিকের উক্তি।
তিনি আরও বলেন, পিসিওডির ফলে উর্বরতা সংক্রান্ত সমস্যা দেখা দেয়, তবে এটি সারবে না এমন নয়।
Source: theindusparent